ভারতের সংবিধান - উৎস ও প্রস্তাবনা | Indian Constitution MCQ
![]() |
ভারতের সংবিধান - উৎস ও প্রস্তাবনা |
ভারতীয় সংবিধানের উৎস রূপে বিদেশী সংবিধান ও ব্রিটিশ আইন
পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধান থেকে ভারতীয় সংবিধান রচয়িতারা উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েকটি দেশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় সংবিধানের কোনো কোনো বিষয়ের উপর মার্কিন সংবিধানের প্রভাব খুব বেশি। আবার নির্দিষ্ট কতকগুলি ক্ষেত্রে ভারতের সংবিধান পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আয়ারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করেছে। তবে গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত ভারত শাসন আইন, বিশেষত ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ হল স্বাধীন ভারতের নতুন সংবিধানের প্রধান উৎস।
সংবিধানের বিভিন্ন অংশ কোন কোন দেশের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে
আমেরিকা (USA): প্রস্তাবনা, লিখিত সংবিধান, উপরাষ্ট্রপতি, মৌলিক অধিকার, সুপ্রিম কোর্ট ও বিচার ব্যবস্থা, Provision of States, Removal of Judges, Judicial Review (137 ধারা)।
ব্রিটেন (UK): মন্ত্রিপরিষদ/সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রী, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, নিম্নকক্ষ অধিকতর শক্তিশালী, এক নাগরিকত্ব, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার (লোকসভার), স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, জনস্বার্থ মামলা, আইনি শাসন (Rule of Law), পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি।
সোভিয়েত রাশিয়া: মৌলিক কর্তব্য, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা।
অস্ট্রেলিয়া: যৌথতালিকা প্রস্তাবনার ভাষা, কেন্দ্র—রাজ্য সম্পর্ক (বাণিজ্যের ক্ষেত্রে)।
জাপান: সুপ্রিম কোর্টের গঠন।
দক্ষিণ আফ্রিকা: সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি (Constitutional Amendment).
কানাডা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা (কেন্দ্রীয় প্রবণতার আধিক্য), কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার বন্টন।
আয়ারল্যান্ড: নির্দেশমূলক নীতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সদস্য মনোনয়ন।
ফ্রান্স: প্রজাতন্ত্র (Republic) ও সাম্য (Equality) শব্দ দুটি নেওয়া হয়।
জার্মানী: জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার বাতিল।
প্রস্তাবনা (Preamble)
◼️ প্রস্তাবনা রচয়িতা: জওহরলাল নেহেরু
◼️ নেওয়া হয়েছে: আমেরিকার সংবিধান থেকে
◼️ ভাষা হচ্ছে: অস্ট্রেলিয়া সংবিধানের অনুকরণে
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে—
"আমরা ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, চিন্তা মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার সমতা সৃষ্টি এবং তাদের সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব গড়ে তুলে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের গণপরিষদে আজ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।"
প্রস্তাবনাকে—
◼️ 'Political Horoscope' বলেছেন — K. M. Munshi.
◼️ 'Identity card of the Constitution' বলেছেন — N. A. Palkhiwala.
◼️ 'Key of the Constitution' বলেছেন — Earnest Barker.
◼️ 'Soul of the Constitution' বলেছেন — Thakurdas Bargav.
🌑 বর্তমানে, ভারতীয় সংবিধানে প্রস্তাবনায় ভারতকে যে রূপ রাষ্ট্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে তা হল সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র।
◾ 'সার্বভৌম' (Sovereign): কথাটির অর্থ হল ভারত অভ্যন্তরীণ এবং বহিব্যপারে সকল রকম বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।
◾ 'সমাজতন্ত্র' (Socialist): মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমাজতন্ত্র শব্দটি ছিল না। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধন অনুসারে ভারতকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।
সমাজতন্ত্রের মূল বক্তব্য অনুসারে উৎপাদনের উৎসগুলির সামাজিক মালিকানা এবং উৎপন্ন সামাজিক দ্রব্যসীমার সামাজিক মালিকানা বন্টন-ব্যবস্থাকে বোঝায়।
◾ 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular): সংবিধানের ৪২তম (১৯৭৬) সংশোধনের মাধ্যমে 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি ও প্রস্তাবনায় সংযুক্ত হয়েছে। এর অর্থ হল রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ।
◾ 'গণতন্ত্র' (Democratic): প্রস্তাবনায় 'গণতন্ত্র' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ব্যবস্থাই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। ভারতে রাষ্ট্রনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা সংবিধানের ৩২৬ ধারায় গৃহীত হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি, আইনের অনুশাসন এবং স্বাধীন বিচারবিভাগের মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
◾ 'সাধারণতন্ত্র' (Republic): প্রস্তাবনায় গণতন্ত্রের সঙ্গে সাধারণতন্ত্র (প্রজাতন্ত্র) শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণভাবে গণতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্র সমার্থক বলে প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু উভয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বর্তমান। গণতন্ত্রের মত সাধারণতন্ত্রেও জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত সরকার থাকে। অধিকন্তু সাধারণতন্ত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ হয় নির্বাচনমূলক। এখানে বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকার মূলক কোন রাজপদ থাকে না। রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সময়ের জন্য নির্বাচিত হন।
◾ 'ভাতৃত্ববোধ' (Fraternity): প্রস্তাবনার শেষে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য সকল নাগরিকের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে 'সংহতি' শব্দটি সংযুক্ত হয়েছে। ভারতীয় মাত্রই একই দেশমাতার সন্তান এ ধারণাটি সকলের মধ্যে জাগ্রত করায় এর উদ্দেশ্য। প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি সকল নাগরিকের শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছাড়া দেশের ঐক্য ও সংগতি বজায় রাখা অসম্ভব।
🌑 ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি, যখন ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হয়, তখন সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে যে রূপ রাষ্ট্ররূপে বর্ণনা করা হয়েছিল, তা হল সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র।
🌑 ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি খসড়া কমিটির সম্মুখে উত্থাপন করেন জওহরলাল নেহেরু।
🌑 ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শ গৃহীত হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ থেকে।
🌑 ১৯৭৬ সালে, ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এই কথাগুলো সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজ পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি সংশোধন করা হয়েছে মাত্র একবার।
🌑 ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটিকে ভারতীয় সংবিধানের আত্মা বলে মনে করা হয়।
🌑 বেরুবাড়ি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা ভারতীয় সংবিধানের অংশ নয়। ১৯৭৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কেশবানন্দ ভারতী মামলায় তার পূর্বের রায় পরিবর্তন করে রায় দান করে যে সংবিধানের প্রস্তাবনা ভারতীয় সংবিধানের অংশ।
Please do not enter any spam link in the comment box.