ভারতে কোম্পানির আমলে শাসনতান্ত্রিক ও বিচারবিভাগীয় সংস্কারসমূহ
![]() |
ভারতে কোম্পানির আমলে শাসনতান্ত্রিক ও বিচারবিভাগীয় সংস্কারসমূহ |
✦ শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ✦
✥ ওয়ারেন্ট হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ)
❑ লন্ডনে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির 'কোর্ট অফ ডাইরেক্টরস' ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর এবং পরবর্তীকালে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গভর্নর জেনারেল রূপে নিযুক্ত করেন।
❑ এপ্রিল ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে হেস্টিংস ক্লাইভ প্রকাশিত দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটান।
❑ বাংলার দেওয়ান রেজা খাঁ ও নায়েব নাজিম সিতাব রায় পদচ্যুত হন এবং দুটি পদ বিলুপ্ত হয়।
❑ কোম্পানির রাজস্ববিভাগ ও কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়।
❑ তিনি বাংলার নবাবদের প্রাপ্ত ভাতার পরিমাণও হ্রাস করেছিলেন।
❑ ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস দেশে ফিরে যান এবং 'হাউস অফ কমন্স' এবং 'হাউস অফ লর্ডস'এ তার বিরুদ্ধে 'ইমপিচমেন্ট' আনা হয়।
✥ লর্ড কর্ণওয়ালিস (১৭৮৬-১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ)
❑ ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে আসেন।
❑ কর্ণওয়ালিস হেস্টিংস প্রবর্তিত বাংলাদেশের ৩৫টি জেলার পুনর্ববিন্যাস করে ২৩টি জেলায় বিভক্ত করেন। পরে যা ২৮ করা হয়।
❑ শাসনবিভাগ থেকে বিচারবিভাগকে পৃথক করেন এবং বাণিজ্য বিভাগকেও শাসনতান্ত্রিক বিভাগ থেকে পৃথক করেন।
❑ জেলা শাসনের জন্য জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগ করা হয়।
❑ তিনি কর্মচারীদের মধ্যে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, নিয়মানুবর্তিতা ও দক্ষতাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে সকল নীতি ও কর্মপদ্ধতি বিধিবদ্ধ করেছিলেন (১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে) সেটিই 'কর্ণওয়ালিস কোড' নামে পরিচিত। শাসনতান্ত্রিক দক্ষতা বৃদ্ধি ছিল এর মূল লক্ষ্য। এই কোড পরোক্ষভাবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ভিত্তি রচনা করেছিল।
✥ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ)
❑ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকাল 'সংস্কারের যুগ' হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি ইংল্যান্ডের বুদ্ধিজীবী জেরেমি বেন্থামের হিতবাদী বা উপযোগবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
❑ তিনি কয়েকটি জেলা নিয়ে একটি ডিভিশন বা বিভাগ গঠন করেন। সেখানে 'কমিশনার' নামক একটি নতুন পদের সৃষ্টি করা হয়।
❑ জেলাশাসন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
❑ বেন্টিঙ্ক জেলাগুলিকে আবার কতকগুলি মহকুমায় বিভক্ত করেন। জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মহকুমা গুলির শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে অর্পিত হয়।
❑ উচ্চ পদে ইউরোপীয়দের শুধুমাত্র নিয়োগের প্রথা বাতিল করে ভারতীয়দের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি 6;;, সদর আমিন প্রভৃতি পদে নিযুক্ত করার কথা বলা হয়।
❑ বেন্টিঙ্ক লর্ড মেকলের নেতৃত্বে গঠিত একটি আইন কমিশনের হাতে ভারতীয় আইন বিধি সংকলনের দায়িত্ব দেন। এভাবে ভারতীয় আইনবিধি 'ইন্ডিয়ান পেনাল কোড' রচিত হয়।
✥ লর্ড ডালহৌসি (১৮৪৮-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ)
❑ ঐতিহাসিক পারসিভ্যাল স্পিয়ার লর্ড ডালহৌসিকে আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করেন।
❑ তাকে 'আধুনিক পাঞ্জাবের জনক' বলা হয়।
❑ তিনি লাহোর থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেন।
❑ পাঞ্জাবে জলসেচের জন্য সিন্ধু ও অন্যান্য নদীর সঙ্গে সংযোগকারী খাল খনন করেন।
❑ তিনি বাংলা প্রদেশে লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করেন।
❑ তিনি জনকৃত্যক দপ্তর বা PWD গঠন করেন।
❑ তার আমলে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ২০০ মাইল রেলপথ বিস্তৃত হয়। ডালহৌসিকে 'ভারতের রেলপথের জনক' বলা হয়।
❑ তার আমলে কলকাতা থেকে আগ্রা পর্যন্ত ভারতের প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ) স্থাপিত হয়।
❑ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে জল বিভাগীয় আইন দ্বারা ডাক ব্যবস্থার উন্নতি করেন এবং তিনি ডাকটিকিটের প্রচলন করেন।
❑ লর্ড ডালহৌসি সিমলা শহরকে সরকারের গ্রীষ্মকালীন শাসনকেন্দ্র বা রাজধানীতে পরিণত করেন।
❑ লর্ড ডালহৌসি বাংলার কোলন্দাজ সেনার সদর দপ্তর কলকাতা থেকে মিরাটে স্থানান্তরিত করেন।
✦ পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার ✦
✥ ওয়ারেন্ট হেস্টিংস -
❑ ওয়ারেন হেস্টিংস-ই প্রথম এদেশে পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
❑ তিনি বাংলা ও বিহারকে যথাক্রমে দশ ও আটটি ফৌজদারি জেলায় বিভক্ত করেন। প্রতি জেলায় ১টি করে ফৌজদারি থানা এবং সেখানে ১ জন দেশীয় ফৌজদার নিযুক্ত করেন। ফৌজদার ছিলেন জেলার প্রধান পুলিশ কর্মচারী।
❑ প্রতি থানায় ১টি করে জেলখানা স্থাপন করা হয়।
❑ ফৌজদারকে সহায়তা করার জন্য ৩৪ জন কর্মচারীর মধ্যে ২০ জন সিপাই ছিল।
❑ শহরে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব ছিল কোতোয়ালদের হাতে।
✥ লর্ড কর্ণওয়ালিস -
❑ কর্ণওয়ালিস নতুন পুলিশি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।
❑ জমিদারদের পুলিশি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
❑ তিনি প্রতিটি জেলাকে কতকগুলি থানায় বিভক্ত করেন। প্রতি থানায় ১ জন করে ভারতীয় দারোগা নিযুক্ত করেন। তার অধীনে ২০ থেকে ৩০ জন কনস্টেবল থাকত।
❑ গ্রামের আইন শৃঙ্খলা চৌকিদার দেখতো মেপমাটি দারোগার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।
❑ কলকাতা শহরে থাকতো ১ জন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট। তবে অন্যান্য শহরে আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে কোতোয়াল নিযুক্ত হয়।
✦ বিচার বিভাগীয় সংস্কার ✦
✥ ওয়ারেন্ট হেস্টিংস -
❑ হেস্টিংস বাংলাকে ৩৫টি জেলায় বিভক্ত করেন। তিনি প্রতিটি জেলায় ১টি করে মফঃস্বল দেওয়ানী আদালত ও মফঃস্বল ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেন।
❑ আদালত গুলিতে জেলা কালেক্টর হিন্দু পন্ডিত ও কাজীর সহায়তায় বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
❑ জমিদারের বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়।
❑ কলকাতায় সদর দেওয়ানী আদালত ও মুর্শিদাবাদে সদর নিজামত আদালত নামে দুটি পৃথক আদালত স্থাপন করা হয়।
❑ সদর নিজামত আদালতের প্রধান বিচারপতিদের নবাব নিযুক্ত করতেন। নবাবের প্রতিনিধি ও প্রধান কাজী এই আদালতের বিচার করতেন।
❑ সদর দেওয়ানী আদালতে গভর্নর ও তার কাউন্সিলের দু'জন সদস্য বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
❑ মফঃস্বল দেওয়ানী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতায় অবস্থিত সদর দেওয়ানী আদালতে আপিল করা যেত।
❑ তার আমলে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। স্যার এলিজা ইম্পে সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।
✥ লর্ড কর্ণওয়ালিস -
❑ কর্ণওয়ালিস সদর নিজামত আদালতকে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা স্থানান্তরিত করেন এবং সপার্ষদ গভর্নর জেনারেলের হাতে বিচারের ভার দেন।
❑ কলকাতা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় চারটি ভ্রাম্যমান আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। দু'জন ইংরেজি বিচারক কাজী ও মুফতিকে নিয়ে প্রতি জেলায় দু'বার আদালত বসত।
❑ জেলা কালেক্টরদের স্থলে জেলার বিচারের ভার জেলা জজের হাতে দেওয়া হয়। এরা দেওয়ানী মামলার বিচার করতেন।
❑ কর্ণওয়ালিসের আমলে সর্বনিম্ন আদালত ছিল মুন্সেফ আদালত। যেখানে ৫০ টাকা পর্যন্ত মুল্যের মামলার বিচার করা যেত।
❑ জেলা আদালতের উপরে ছিল চারটি প্রাদেশিক আদালত, যেগুলি কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা ও পাটনায় অবস্থিত ছিল।
❑ এর উপরে ছিল কলকাতার সর্বোচ্চ সদর দেওয়ানী আদালত।
❑ কর্ণওয়ালিস সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি রোধের জন্য বিচার বিভাগের কাছে অভিযোগ করার ব্যবস্থা করেন।
✥ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক -
❑ দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বেন্টিঙ্ক কর্ণওয়ালিস প্রবর্তিত ভ্রাম্যমান ফৌজদারি আদালত ও প্রাদেশিক আপিল আদালত লোপ করেন।
❑ জেলা জজের নাম পরিবর্তন করে সেশন জজ রাখা হয় এবং এদের হাতে দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
❑ দেওয়ানী মামলার বিচারের কাজে ভারতীয়দের নিয়োগের পাশাপাশি তাদের বেতন ও পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।
❑ কাজের সুবিধার্থে এলাহাবাদে সদর দেওয়ানী ও সদর নিজামত আদালত স্থাপন করা হয়।
Read More...
➢ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের সমাধিস্থল তালিকা
➢ ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলির তালিকা
Please do not enter any spam link in the comment box.