স্থানান্তর কৃষি: প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs) ও বিস্তারিত উত্তর
![]() |
স্থানান্তর কৃষি |
স্থানান্তর কৃষি: আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর
কৃষি মানব সভ্যতার ভিত্তি, আর এই ভিত্তির এক প্রাচীন ও বৈচিত্র্যময় রূপ হলো স্থানান্তর কৃষি (Shifting Cultivation), যা আমাদের দেশে ঝুম চাষ নামেও পরিচিত। এটি কেবল একটি চাষ পদ্ধতি নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের এক দীর্ঘ ইতিহাস। তবে, এই ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি নিয়ে আধুনিক যুগে নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এর পরিবেশগত প্রভাব, সামাজিক দিক এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে অনেক জিজ্ঞাসা।
এই ব্লগ পোস্টে, আমরা স্থানান্তর কৃষি নিয়ে আপনাদের মনে আসা সবচেয়ে সাধারণ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেব। সহজ ভাষায় এর পদ্ধতি, এর গুরুত্ব, এবং এর সাথে জড়িত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন, এই প্রাচীন কৃষির রহস্যগুলো উন্মোচন করা যাক!
বিশ্বজুড়ে স্থানান্তর কৃষির পরিচিত নামসমূহ
১. স্থানান্তর কৃষি আসলে কী?
স্থানান্তর কৃষি হলো এমন একটি কৃষিপদ্ধতি যেখানে কৃষকেরা বনের একটি ছোট অংশ পরিষ্কার করে, গাছপালা কেটে শুকিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ছাই মাটির উর্বরতা বাড়ায়। এরপর সেই জমিতে কয়েক বছর ধরে ফসল ফলানো হয়। মাটির উর্বরতা কমে গেলে বা আগাছার পরিমাণ বেড়ে গেলে কৃষকেরা সেই জমি ছেড়ে নতুন আরেকটি জমি পরিষ্কার করে সেখানে চাষ শুরু করে। পরিত্যক্ত জমিটি প্রাকৃতিকভাবে নিজের উর্বরতা ফিরে পাওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়।
২. কেন এই কৃষিপদ্ধতি অবলম্বন করা হয়?
ঐতিহাসিকভাবে, এই পদ্ধতি মূলত পাহাড়ি এবং বনাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকায় প্রচলিত ছিল, যেখানে সমতল উর্বর জমির অভাব ছিল। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি ছিল টিকে থাকার এবং খাদ্য সংগ্রহের একটি কার্যকর উপায়। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
❑ জমির উর্বরতা বৃদ্ধি: পোড়ানো ছাই মাটিতে পটাশ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ যোগ করে, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
❑ আগাছা ও কীটপতঙ্গ দমন: আগুন আগাছা, পোকামাকড় এবং রোগের জীবাণু ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
❑ সহজ পদ্ধতি: এটি তুলনামূলকভাবে কম শ্রমনির্ভর এবং আধুনিক কৃষি উপকরণের প্রয়োজন হয় না।
৩. স্থানান্তর কৃষির কি কোনো পরিবেশগত প্রভাব আছে?
হ্যাঁ, স্থানান্তর কৃষির কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে, বিশেষত যখন এটি খুব ঘন ঘন করা হয় বা বিশাল এলাকা জুড়ে করা হয়:
❑ বন উজাড়: নতুন জমি তৈরি করতে বন কাটা হয়, যা বন উজাড়ের অন্যতম কারণ।
❑ মৃত্তিকা ক্ষয়: গাছপালা কেটে ফেলার ফলে মাটির ওপরের স্তর আলগা হয়ে যায়, যা বৃষ্টি বা বাতাসের কারণে সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
❑ জৈব বৈচিত্র্য হ্রাস: বনের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী তাদের বাসস্থান হারায়।
❑ জলবায়ু পরিবর্তন: গাছ পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা গ্রিনহাউস গ্যাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ।
৪. ভারতের কোন কোন রাজ্যে এই কৃষি পদ্ধতি প্রচলিত?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে, যেমন – আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ এবং মণিপুর-এ ঝুম চাষ ব্যাপক প্রচলিত। এছাড়া, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরালার কিছু আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলেও এই পদ্ধতি বিভিন্ন নামে প্রচলিত।
৫. স্থানান্তর কৃষির কি কোনো বিকল্প আছে?
হ্যাঁ, পরিবেশগত প্রভাব কমানোর জন্য এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে:
❑ স্থায়ী কৃষি পদ্ধতি: ধাপ চাষ (Terrace Cultivation) বা সোপান কৃষি যেখানে পাহাড়ের ঢালে ধাপ কেটে চাষ করা হয়, যা মাটির ক্ষয় রোধ করে।
❑ বনভিত্তিক কৃষি (Agroforestry): ফসল চাষের পাশাপাশি গাছ লাগানো, যা মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
❑ আধুনিক কৃষি কৌশল: উন্নত বীজ, সার এবং সেচ ব্যবস্থার ব্যবহার করে কম জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন করা।
❑ জীবিকা নির্বাহের বিকল্প: আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য বনাঞ্চল নির্ভর বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা, যাতে তাদের কৃষির উপর নির্ভরশীলতা কমে।
স্থানান্তর কৃষি কেবল একটি চাষের ধরন নয়, এটি একটি জীবনধারা। পরিবেশগত দিকগুলো বিবেচনা করে এই প্রাচীন পদ্ধতির টেকসই বিকল্প খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।
৬. স্থানান্তর কৃষিকে কেন 'ঝুম চাষ' বলা হয়?
'ঝুম' শব্দটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই কৃষিপদ্ধতির জন্য বহুল ব্যবহৃত একটি স্থানীয় নাম। এটি সাধারণত এই অঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি শব্দ। এই নামটির উৎপত্তি সম্ভবত 'ঝুমুর' থেকে, যা নাচের একটি ধরন, যেখানে লোকজনের একটি দল একসঙ্গে কাজ করে এবং তারপর অন্য জায়গায় চলে যায়, অনেকটা স্থানান্তর কৃষির মতোই। তবে, এটি একটি আঞ্চলিক নাম এবং অন্যান্য অঞ্চলে এর ভিন্ন নাম রয়েছে।
৭. এই কৃষিপদ্ধতির সঙ্গে জড়িত প্রধান ফসলগুলি কী কী?
স্থানান্তর কৃষিতে মূলত স্বল্পমেয়াদী ফসল চাষ করা হয় যা দ্রুত জন্মায় এবং কম পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। প্রধান ফসলগুলির মধ্যে রয়েছে:
❑ ধান: এটি প্রায় সব অঞ্চলেই প্রধান ফসল হিসেবে চাষ করা হয়।
❑ ভুট্টা: এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য।
❑ জোয়ার ও বাজরা: কিছু শুষ্ক বা কম উর্বর অঞ্চলে এই ফসলগুলি চাষ করা হয়।
❑ ডাল: বিভিন্ন ধরনের ডাল জাতীয় শস্য যেমন মুগ, মসুর, অড়হর ইত্যাদি।
❑ কন্দমূল: আলু, মিষ্টি আলু, কচু ইত্যাদি।
❑ শাকসবজি: স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি।
৮. স্থানান্তর কৃষির আধুনিকীকরণ বা উন্নতকরণের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা স্থানান্তর কৃষির পরিবেশগত প্রভাব কমাতে এবং এর সাথে জড়িত জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে:
❑ ধাপ চাষের প্রচার: পাহাড়ি ঢালে ধাপ কেটে স্থায়ী কৃষি পদ্ধতি প্রচলনের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
❑ এগ্রোফরেস্ট্রি (Agroforestry): কৃষি কাজের পাশাপাশি গাছ লাগানোর মাধ্যমে মাটি সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
❑ উন্নত বীজ ও সার সরবরাহ: কৃষকদের মধ্যে উন্নত মানের বীজ এবং পরিবেশবান্ধব সারের ব্যবহার জনপ্রিয় করা হচ্ছে।
❑ বিকল্প জীবিকার সুযোগ: পশুপালন, হস্তশিল্প, ইকো-ট্যুরিজম ইত্যাদির মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প আয়ের উৎস তৈরি করা হচ্ছে যাতে তাদের কৃষির উপর চাপ কমে।
❑ সচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানান্তর কৃষির ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে।
৯. স্থানান্তর কৃষি কি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তায় কোনো ভূমিকা রাখে?
হ্যাঁ, অবশ্যই রাখে। যদিও এর পদ্ধতি পরিবেশগতভাবে কিছুটা বিতর্কিত, তবে ভারতের দুর্গম পাহাড়ি এবং বনাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে, যেখানে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি সহজে পৌঁছায় না, সেখানে স্থানান্তর কৃষি স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার একটি প্রধান উৎস। এটি তাদের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে এবং জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করে। তবে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ বাড়ার সাথে সাথে এর ভূমিকা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
১০. 'স্থানান্তর কৃষি' এবং 'ধাপ চাষ' এর মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
❑ স্থানান্তর কৃষি (Shifting Cultivation/ঝুম): এই পদ্ধতিতে জমি পরিষ্কার করে (সাধারণত বন কেটে আগুন লাগিয়ে) অস্থায়ীভাবে চাষ করা হয়। কয়েক বছর পর মাটির উর্বরতা কমে গেলে জমিটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন জমিতে স্থানান্তর করা হয়। এটি অস্থায়ী প্রকৃতির।
❑ ধাপ চাষ (Terrace Cultivation/সোপান কৃষি): এই পদ্ধতিতে পাহাড়ের ঢালে সিঁড়ির মতো ধাপ কেটে স্থায়ীভাবে চাষ করা হয়। প্রতিটি ধাপ মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং জল ধরে রাখতে সাহায্য করে। এটি স্থায়ী প্রকৃতির এবং মাটি ও জলের সংরক্ষণে সহায়তা করে।
১১. স্থানান্তর কৃষির সঙ্গে উপজাতি বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক কেমন?
স্থানান্তর কৃষি বহু শতাব্দী ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিশেষ করে ভারতের আদিবাসী এবং উপজাতি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের জন্য এটি কেবল খাদ্য উৎপাদনের একটি উপায় নয়, বরং এটি তাদের সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। জমি পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে ফসল রোপণ এবং ফসল কাটা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই তাদের সম্মিলিত শ্রম, উৎসব এবং রীতিনীতি প্রতিফলিত হয়। এই পদ্ধতি তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার এবং নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
১২. স্থানান্তর কৃষি কি কেবল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়?
মূলত খাদ্যশস্য (যেমন ধান, ভুট্টা) এবং কন্দমূল (যেমন আলু, কচু) উৎপাদনের জন্য স্থানান্তর কৃষি ব্যবহৃত হলেও, কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সবজি, ডাল এবং এমনকি কিছু ঔষধি গাছও চাষ করা হয়। তবে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের জন্য এটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় না, কারণ এর উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিজস্ব খাদ্য চাহিদা পূরণ করা।
১৩. স্থানান্তর কৃষি কি সবসময় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর?
স্থানান্তর কৃষি সবসময়ই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর – এই ধারণাটি সরলীকরণ করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, যখন জনসংখ্যা কম ছিল এবং পরিত্যক্ত জমিকে তার উর্বরতা ফিরে পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় (প্রায় ১০-২০ বছর বা তারও বেশি) দেওয়া হতো, তখন এই পদ্ধতি পরিবেশের উপর তুলনামূলকভাবে কম নেতিবাচক প্রভাব ফেলত। বরং, কিছু ক্ষেত্রে এটি বনের পুনর্জন্ম এবং জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে সাহায্য করত।
তবে, আধুনিক যুগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে 'ফলো পিরিয়ড' (যে সময়ে জমি পরিত্যক্ত থাকে) কমে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই একই জমিতে বারবার চাষ করায় মাটি দ্রুত তার উর্বরতা হারাচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে এবং ব্যাপক হারে মৃত্তিকা ক্ষয় হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেই এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে।
১৪. 'ফলো পিরিয়ড' বলতে কী বোঝায় এবং এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
'ফলো পিরিয়ড' (Fallow Period) বলতে সেই সময়কালকে বোঝায় যখন স্থানান্তর কৃষির মাধ্যমে চাষ করা একটি জমিকে ফসল ফলানোর পর প্রাকৃতিক উপায়ে তার উর্বরতা ফিরে পাওয়ার জন্য পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়। এই সময়কালে গাছপালা আবার বেড়ে ওঠে, জৈব পদার্থের পচন ঘটে এবং মাটির পুষ্টি উপাদানগুলো পুনরায় সঞ্চিত হয়।
স্থানান্তর কৃষির পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি দীর্ঘ ফলো পিরিয়ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি ফলো পিরিয়ড যথেষ্ট দীর্ঘ না হয় (যেমন, ৫ বছরেরও কম), তাহলে মাটি তার উর্বরতা সম্পূর্ণরূপে ফিরে পায় না, যা ফলস্বরূপ মাটির ক্ষয়, পুষ্টির অভাব এবং কম ফলনের দিকে নিয়ে যায়।
১৫. স্থানান্তর কৃষির আইনি অবস্থা কী? এটি কি ভারতের আইনে স্বীকৃত?
ভারতে স্থানান্তর কৃষি একটি জটিল আইনি বিষয়। ঐতিহাসিকভাবে, এটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রচলিত অধিকারের অংশ ছিল। তবে, বন সংরক্ষণ আইন (Forest Conservation Act) এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন (Wildlife Protection Act)-এর মতো আইনগুলি বনভূমি পরিষ্কার করা এবং চাষাবাদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর ফলে, অনেক ক্ষেত্রে স্থানান্তর কৃষিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় বা এর উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
যদিও ভারত সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় বন অধিকার আইন, ২০০৬ (Forest Rights Act, 2006) প্রণয়ন করেছে, যা আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বনাঞ্চল এবং জীবনধারণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, তবুও স্থানান্তর কৃষির চর্চা এবং বন সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার এই পদ্ধতিকে নিরুৎসাহিত করে টেকসই বিকল্পগুলির দিকে উৎসাহিত করছে, কিন্তু একই সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রার অধিকারকেও সম্মান জানানোর চেষ্টা করছে।
উপসংহার: ভারসাম্য ও সহাবস্থানের পথে স্থানান্তর কৃষি
স্থানান্তর কৃষি, যা ঝুম চাষ নামেই বেশি পরিচিত, মানব ইতিহাসের এক প্রাচীন এবং অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে ভারতের দুর্গম পাহাড়ি ও বনাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে, এটি কেবল একটি কৃষিপদ্ধতি নয়, বরং স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্কের এক প্রতিচ্ছবি। ধান, ভুট্টা, কন্দমূলের মতো ফসল ফলিয়ে এটি যুগ যুগ ধরে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
তবে, আধুনিক বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবেশ সচেতনতা এবং বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এই প্রাচীন পদ্ধতির উপর নতুন করে আলো ফেলেছে। 'ফলো পিরিয়ড' কমে আসা এবং ঘন ঘন বন উজাড়ের কারণে এর পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব, যেমন - বন ধ্বংস, মৃত্তিকা ক্ষয়, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব - এখন বেশি স্পষ্ট।
প্রশ্ন হলো, তাহলে কি এই প্রাচীন প্রথাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া উচিত? হয়তো নয়। এর মূল্যায়নে প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে এই পদ্ধতি ঐতিহ্যের অংশ, সেখানে টেকসই বিকল্পের দিকে ধাপে ধাপে রূপান্তর জরুরি। ধাপ চাষ, এগ্রোফরেস্ট্রি, উন্নত কৃষি কৌশল এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করা এই রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার উচিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে তাদের আধুনিক, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা।
স্থানান্তর কৃষি আমাদের শেখায় কীভাবে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে পারে। এখন সময় এসেছে এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এমন একটি পথ খুঁজে বের করার, যেখানে পরিবেশের ক্ষতি না করে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান বজায় থাকবে।
Read More...
❑ ভারতের বহুমুখী প্রকল্পসমূহের তালিকা: পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
❑ গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক রাশির একক ও মাত্রা: পরীক্ষার জন্য সহজ তালিকা
❑ ভারতের মিসাইল নিয়ে ৩০টি জিকে প্রশ্নোত্তর
Please do not enter any spam link in the comment box.