বিশ্বজুড়ে স্থানান্তর কৃষির পরিচিত নামসমূহ
![]() |
বিশ্বজুড়ে স্থানান্তর কৃষির পরিচিত নামসমূহ |
স্থানান্তর কৃষি: বৈশ্বিক বৈচিত্র্যের এক ঝলক
কৃষি শুধু মাটির ওপর ফসল ফলানো নয়, এটি মানব সভ্যতার বিবর্তন এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক জীবন্ত ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্থানান্তর কৃষি (Shifting Cultivation)। এটি এমন একটি প্রাচীন পদ্ধতি যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্থানীয় জনগোষ্ঠী দ্বারা প্রচলিত হয়ে আসছে। তবে এর বৈচিত্র্য শুধু পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর নামের মধ্যেও রয়েছে এক মুগ্ধ করার মতো ভিন্নতা।
আমরা প্রায়শই এটিকে ঝুম চাষ (Jhum Cultivation) নামে চিনি, বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এর ব্যাপক প্রচলনের কারণে। কিন্তু এই আদিম কৃষিপদ্ধতিটি ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে প্রতিটি অঞ্চলে নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা এবং পরিবেশের সঙ্গে মিশে ধারণ করেছে বিচিত্র সব নাম। কোথাও এটি 'মিলপা', কোথাও 'লাডাং', আবার কোথাও 'চেনা' – প্রতিটি নামই যেন এক একটি অঞ্চলের কৃষি ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই ব্লগ পোস্টে, আমরা বিশ্বের ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত স্থানান্তর কৃষির কিছু আকর্ষণীয় নামের তালিকা সম্পর্কে জানব।
ভারতের কৃষি - ভারতীয় কৃষির বৈশিষ্ট্য - ভারতীয় কৃষির সমস্যা ও সমাধান
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তর কৃষির বিবিধ নাম
স্থানান্তর কৃষির নাম | অঞ্চলের নাম |
---|---|
রে | ভিয়েতনাম |
তাভি | মাদাগাস্কার |
মাসোল | কঙ্গো (জায়রে নদী উপত্যকা) |
ফ্যাং | নিরক্ষীয় অঞ্চলের আফ্রিকান দেশ |
লোগান | পশ্চিম আফ্রিকা |
কোমাইল | মেক্সিকো |
মিলপা | যুকেতান এবং গুয়েতেমালা |
একহালিন | গোয়াদেলুপ |
মিল্যা | মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকা |
কোনুকো | ভেনেজুয়েলা |
রোকা | ব্রাজিল |
চেতিমিনি | উগান্ডা, জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে |
কাইনজিন | ফিলিপিন্স/td> |
তুঙ্গা | মায়ানমার |
চেনা | শ্রীলঙ্কা |
লাদাং | জাভা এবং ইন্দোনেশিয়া |
তামরাই | থাইল্যান্ড |
হুমা | জাভা এবং ইন্দোনেশিয়া |
ভারতের স্থানান্তর কৃষি: নাম বিভেদ, ঐতিহ্য অবিচ্ছেদ
স্থানান্তর কৃষি, যা ইংরেজিতে 'Shifting Cultivation' বা 'Slash and Burn Agriculture' নামে পরিচিত, ভারতের বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের এক প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী কৃষিপদ্ধতি। এটি কেবল একটি চাষের ধরন নয়, বরং এটি তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের এক প্রতিচ্ছবি। যদিও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে আধুনিক বিশ্বে এর সমালোচনা হয়, তবে ভারতের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে, বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়, এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে।
এই কৃষিপদ্ধতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলির মধ্যে একটি হলো এর ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। ভারতের প্রতিটি অঞ্চল, এমনকি প্রতিটি উপজাতি গোষ্ঠী, এই একই পদ্ধতিকে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকে। আসুন, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত স্থানান্তর কৃষির কিছু উল্লেখযোগ্য নাম এবং তাদের বিশেষত্ব সম্পর্কে জেনে নিই:
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তর কৃষির বিবিধ নাম
উত্তর-পূর্ব ভারত: ঝুম (Jhum) - এক পরিচিত নাম
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি, যেমন – আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং অরুণাচল প্রদেশে স্থানান্তর কৃষি মূলত ঝুম নামে পরিচিত। এটি সম্ভবত ভারতের স্থানান্তর কৃষির সবচেয়ে পরিচিত রূপ। এখানে পাহাড়ের ঢালে বন কেটে, শুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে জমি পরিষ্কার করা হয়। এরপর ছাই মেশানো জমিতে বীজ রোপণ করা হয়। কয়েক বছর ফসল ফলানোর পর মাটির উর্বরতা কমে গেলে জমি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন স্থানে চলে যাওয়া হয়, যাতে পুরনো জমি প্রাকৃতিক উপায়ে উর্বরতা ফিরে পায়।
ভারতের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান জিকে প্রশ্ন উত্তর
ওড়িশা: পোডু (Podu), কোমান (Koman), ব্রিঙ্গা (Bringa), দাবি (Dabi)
ওড়িশার উপজাতি সম্প্রদায়, বিশেষত কোরাপুর, কালাহান্ডি এবং কন্ধমাল জেলার আদিবাসীরা এই পদ্ধতির জন্য একাধিক নাম ব্যবহার করে। পোডু তাদের মধ্যে অন্যতম, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এছাড়াও, কোমান, ব্রিঙ্গা, দাবি ইত্যাদি নামগুলিও ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত।
মধ্যপ্রদেশ: বেওয়ার (Bewar), দহিয়া (Dahia), পেন্দা (Penda)
মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানান্তর কৃষি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বেওয়ার এবং দহিয়া এই দুটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা এই অঞ্চলের বাউগা এবং মারিয়া উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত। বাস্টার জেলায় একে আবার পেন্দা নামেও ডাকা হয়। এই নামগুলি তাদের কৃষি পদ্ধতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরে।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালা: কুমারী (Kumari)
ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, বিশেষ করে কেরালা এবং কর্ণাটকের কিছু অংশে, স্থানান্তর কৃষি কুমারী নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের আর্দ্র আবহাওয়া এবং ঘন বনাঞ্চলের কারণে এই কৃষিপদ্ধতির ধরন কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মূল নীতি একই থাকে।
রাজস্থান: বালরে (Valre) বা বাত্রা (Batara)
শুষ্ক রাজস্থানের কিছু দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায়, বালরে বা বাত্রা নামে স্থানান্তর কৃষি প্রচলিত। এই অঞ্চলের জলবায়ু ও ভূসংস্থানগত পার্থক্যের কারণে এখানে এর প্রয়োগ কিছুটা সীমিত হলেও, স্থানীয় উপজাতিদের টিকে থাকার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
ঝাড়খণ্ড: কুরুয়া (Kuruwa)
ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী কুরুয়া নামে স্থানান্তর কৃষি পদ্ধতি পালন করে। এখানকার বনাঞ্চল এবং পাহাড়ি ভূখণ্ডে এটি একটি সাধারণ কৃষিপদ্ধতি।
আন্ধ্রপ্রদেশ: পোডু (Podu)
আন্ধ্রপ্রদেশেও 'পোডু' নামটি প্রচলিত, যা উড়িষ্যার 'পোডু'-এর মতোই। এই অঞ্চলগুলি একই ধরনের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণে নামের মিল দেখা যায়।
হিমালয় অঞ্চল: খিল (Khil)
হিমালয়ের পাদদেশ এবং কিছু পাহাড়ি অঞ্চলে স্থানান্তর কৃষি খিল নামে পরিচিত। এই শীতল পার্বত্য পরিবেশে এর প্রয়োগ কিছুটা ভিন্নতা লাভ করে।
কেন এত নাম?
এই বিভিন্ন নামগুলি কেবল শব্দের ভিন্নতা নয়, বরং প্রতিটি নামের পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ু, ভূসংস্থান, স্থানীয় ফসলের ধরন এবং সংশ্লিষ্ট উপজাতিদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস। সময়ের সাথে সাথে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কারণে এই প্রাচীন কৃষিপদ্ধতির উপর চাপ বাড়ছে। তবে, এই বৈচিত্র্যময় নামগুলি ভারতের কৃষি ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ চিত্র তুলে ধরে এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
উপসংহার: নামের ভেদে একই সুর, প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্থানান্তর কৃষি পদ্ধতি, তার বৈচিত্র্যময় নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার এক প্রাচীন এবং অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস। ঝুম থেকে মিলপা, লাডাং থেকে পোডু – প্রতিটি নামই কেবল একটি শব্দের ভিন্নতা নয়, বরং এটি নির্দেশ করে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের ভূগোল, জলবায়ু, স্থানীয় ফসল এবং সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির এক গভীর সম্পর্ক।
এই কৃষিপদ্ধতি, যা প্রায়শই 'স্ল্যাশ-অ্যান্ড-বার্ন' নামে পরিচিত, আধুনিক কৃষির মানদণ্ডে বিতর্কিত হতে পারে। তবে, এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, লক্ষ লক্ষ আদিবাসী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রকৃতির সঙ্গে এক সুরে বাঁধা জীবন যাপন করে আসছেন এই পদ্ধতির মাধ্যমেই। এটি তাদের খাদ্য নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধার এক অনন্য নিদর্শন।
যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এই প্রাচীন পদ্ধতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে, তবু এর বৈশ্বিক উপস্থিতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণের বৈচিত্র্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে মানুষ বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং প্রকৃতির সম্পদকে সম্মান করেছে। স্থানান্তর কৃষি তাই কেবল একটি চাষের ধরন নয়, এটি মানব এবং প্রকৃতির মধ্যেকার এক দীর্ঘকালীন, পরিবর্তনশীল সম্পর্কের জীবন্ত দলিল।
আরও পড়ুনঃ স্থানান্তর কৃষি: প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs) ও বিস্তারিত উত্তর
Read More...
❑ পশ্চিমবঙ্গের জেলার ভিত্তিতে প্রধান নদ-নদীসমূহের তালিকা
❑ পরিমাপক যন্ত্রের তালিকা ও তাদের ব্যবহার: সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা
❑ ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্য ও তাদের আরাধ্য দেবতা: একটি সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ
Please do not enter any spam link in the comment box.